Thursday, March 1, 2018

ল্যাম্পপোস্ট



বেকার বকবক #১৭

গোলপোস্ট থেকে শুরু করে ফেসবুক পোস্ট জীবনে কম পোস্টে তো আর ধাক্কা খেলাম না কিন্তু আমাদের পাড়ার মোড়ের মরচে ধরা ল্যাম্পপোস্টের  ধাক্কা, আমি কি ভুলিতে পারি  ? গলির ভেতর তস্য গলিতে এক কোণে রোগা পিলপিলে  ঢ্যাঙা একটা ল্যাম্পপোস্ট।  একটাই।  একটার বেশী ধার্য্য ছিল না মফস্বলের ওই গলিতে।  বেশী আলোর দাবী তখন অন্যায্য।  রাতের অন্ধকারে ওই ল্যাম্পপোস্টই আমাদের একমাত্র আলোর দিশারী।  কিন্তু আলো জ্বলবে কি জ্বলবে না সেটা ভাগ্যের ব্যাপার।  সেই সময় সবকিছুই কেন্দ্রের চক্রান্ত।  তাই ল্যাম্পপোস্টের আলো না জ্বললে আমরা জানতাম কেন জ্বলছে না।  হ্যাপা তো অনেক।  মাঝে মাঝে bulb  কেটে যেত।  তখন Electricity office এ খবর দিতে হোত।  খবর দেওয়া মানে পাড়ার কোন ছেলে গিয়ে বলে আসত "কাকা bulb কেটে গেছে " . নিয়ম ছিল electricity office থেকে কেউ এসে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে।  সরকারবাবু সাইকেলে করে আসতেন। সাইকেলের চেন পরে গেলে একটু দেরী হত ঠিকই কিন্তু আসতেন।  এসে উনি ল্যাম্পের দিকে তাকাতেন।  ওনার ছোট্ট  একটা নোটবুকে কিসব লিখতেন , তারপর চলে যেতেন। তার সপ্তাহ দুই পরে আরেকজন এসে একটা লম্বা লাঠি দিয়ে কিসব করে bulb বদলে যেতেন।  সেইদিন  পাড়ায় পূর্ণিমা।  কিন্তু অমাবস্যাটাই ছিল মোটামুটি   রোজনামচা।   এরকমই এক অমাবস্যার রাতে তীর বেগে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে খেলাম সেই ধাক্কা।   সাইকেল একটু আহত হল , আমার নাক দিয়ে  রক্ত পড়ল অল্প। তখন নতুন নতুন সাইকেল চালিয়ে বন্ধুদের বাড়ি আড্ডা দিতে যাওয়া শুরু করেছি। বাড়ি ঢুকে বললাম এই ধাক্কাটার জন্যই আমার বাড়ি ফিরতে এত দেরী।


সে রাতে ল্যাম্পপোস্টই আমায় উত্তম মধ্যম খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।  তারপর থেকেই যাওয়া আসার পথে ল্যাম্পপোস্টটাকে দেখতাম।  মন দিয়ে দেখতাম, ধাক্কা বাঁচানোর জন্যই হয়ত ।  আস্তে আস্তে ল্যাম্পপোস্টটা সেজে উঠছিলো।  কেউ একটা বিল সেঁটে দিয়ে গেল , হলুদ রঙের।  তাতে লেখা "২৭শে জানুয়ারী ব্রিগেড চলো ".  কদিন পরে ব্রিগেড চলোর ওপরেই কেউ  চিপকে দিয়ে গেল গোলাপী রঙের কাগজে "দাদ হাজা চুলকানির মলম"।  ভোটের আগে অনেক কাগজে সেজে উঠল ল্যাম্পপোস্টটা , সবার জন্য সহজ সরল ভাষায় লেখা কোন চিহ্নে কাকে ভোট দিতে হবে। পনেরোই অগাস্টে তেরঙা flag লটকানো আবার তার কদিন পরে বাড়ি বসে সহজে পয়সা উপার্জনের উপায় বাতলানো বিল। এভাবেই আস্তে আস্তে পোস্টটা একদিন নিজের মরচে পরা পুরাতনী অবয়বটাকে ঢেকে ফেলল রঙ বেরঙের কাগজে।  "বাবলুদার জয়েন্ট এন্ট্রান্সের কোচিং" থেকে  "সন্তান অবাধ্য ? স্বামীকে বশ করতে চান ? ". "হোমিও ক্লিনিক"  থেকে "রিষড়া স্টেশনের পূর্বদিকের গলি দুমিনিটের হাঁটা পথ"।  বন্ধুদের আড্ডায় ল্যাম্পপোস্টে কি লেখা আছে সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধিৎসা , উৎসাহ , বচসা এসব মিলেমিশে নিজে শেখ কারিক্ৰম। রাজনীতি থেকে education , বুজরুকি থেকে জীবন রহস্য সবই উঠে আসছে ল্যাম্পপোস্ট থেকে।  ছোট থেকে বড় হচ্ছি আর ঢ্যাঙা পোস্টটা আস্তে আস্তে আমাদের জ্ঞানের আলো হয়ে উঠছে।  Bulb  কেটে যাচ্ছে তবু নতুন নতুন বিষয়ে আলোকপাত করছে হতচ্ছাড়া ল্যাম্পপোস্ট রোজ রোজ।  তাই নাক দিয়ে রক্ত না পড়লেও ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খাওয়াটা জারি ছিল বেশ কয়েক বছর। অন্যরকম ধাক্কা।

অনেককাল পরে বছর দুয়েক আগে ওই  গলির মোড়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ সেই ল্যাম্পপোস্টের সাথে দেখা।  চেহারায় বয়সের ছাপ।  Knowledge-base এ এখন তৃণমূল , Vodafone  আরও কিসব।  নিজে  আর আলো দেয় না , পাশে দাঁড়ান একটা ছোকরা ত্রিফলা light ওকে আলো দেয় এখন।  থমকে দাঁড়ালাম দুমিনিট।  মিটিমিটি একটু হাসলাম।  পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে  থাকা ছেলেগুলো আমাকে পাগল ভাবছিল হয়ত , ভাবলে ভাবুক।  কিশোরবেলার জ্ঞানের আলোকে তাই বলে কি আর শ্রদ্ধা দেখাতে দুমিনিট নীরবতা দেবো না ?


আগের বকবক 

Readers Loved These Posts