বাড়ির কাছেই আমাদের লাইব্রেরী। সময় পেলেই আমি লাইব্রেরীতে গিয়ে সময় কাটাই। কাটাতাম বলা উচিত , কারন মার্চ মাস থেকে লাইব্রেরী বন্ধ। তার আগে অবধি সপ্তাহে অন্তত তিন দিন রোজ কয়েক ঘণ্টার জন্য আমার আস্তানা ছিল ওই লাইব্রেরী। চারদিকে বই , বইয়ের গন্ধ আর যে যার মতো পড়াশুনা করা বিভিন্ন বয়েসের মানুষের মধ্যে বসে নিজেও কিছু বই নাড়াচাড়া করে সময় কাটত খুব ভাল। আমেরিকায় পাবলিক লাইব্রেরী ফ্রি। অর্থাৎ যে কেউ এসে এখানে বসে পড়াশুনা করতে পারেন , সময় কাটাতে পারেন। বই ম্যাগাজিন অডিও ভিডিও মিডিয়া ছাড়াও ফ্রি ইন্টারনেট , কম্পিউটার ইত্যাদিও পাওয়া যায় লাইব্রেরীতে। যাদের কম্পিউটার কেনার রেস্ত নেই বা বাড়িতে ইন্টারনেট নেই এরকম মানুষরাও এখানে এসে কাজ সারতে পারেন প্রয়োজন মতো। বিকেল থেকে রাত অবধি তাই অনেক মানুষ আসেন লাইব্রেরীতে।
লাইব্রেরীর উল্টো দিকেই সিটি হল। দুটো বিল্ডিংয়ের মাঝে অনেকটা সবুজ। গাছপালা , ঢেউ খেলানো লন। ছোট একটা লেক। লেকে হাঁস। মাঝে অনেকটা জায়গা জুড়ে পার্কিং লট। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে একটু হেঁটে ঢুকতে হয় লাইব্রেরীতে। যেহেতু বিকেল সন্ধ্যের দিকে বেশ ভিড় তাই বেশিরভাগ সময় একটু দূরেই পার্ক করতে হত আমায়। লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দিব্যি লাগত। একদিন পার্ক করে লাইব্রেরীর দিকে যাওয়ার সময় একটা গাড়ির ওপর চোখ পড়ল। সাধারণ একটা স্ট্যান্ডার্ড সাইজের গাড়ি। কিন্তু গাড়ি ভর্তি অনেক জিনিস। বালিশ কম্বল বিছানা, জামা কাপড় থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেকরকম সামগ্রী দিয়ে গাড়িটা একেবারে বোঝাই । এত বোঝাই যে সবকটা জানলায় ঠেসে আছে মালপত্র , কোনরকমে ড্রাইভার সিটে কেউ একজন বসতে পারে। দেখে একটু অবাক হলাম।
কিছুদিন পর আরেকদিন লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আবার দেখলাম সেই গাড়িটাই। একই জায়গায় পার্ক করা। এবারে ড্রাইভার সিটে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। আমার সাথে একবার চোখে চোখ হতেই উনি চোখ সরিয়ে নিলেন। তারপর থেকে যখনই আমি লাইব্রেরী যেতাম খুঁজে দেখতাম ওই গাড়িটা আছে কিনা। থাকত। ওই ভদ্রমহিলাও থাকতেন গাড়িতে। কখনও হয়ত একা বসে কফি খাচ্ছেন , কখনও আবার গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কিছু জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন। কদিন দেখার পর বুঝে গেছিলাম ওই গাড়িটাই ওনার ঘরবাড়ি , ওই গাড়ির মধ্যেই ঠাসা আছে ওনার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি। 'হোম' শব্দটার সাথে 'লেস' শব্দের যৎসামান্যতার লেজুড় জুড়ে আমেরিকা এরকম মানুষদের হোমলেস বলে।
গত মার্চ মাস অবধি প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই দুতিনবার ওনার সামনে দিয়ে হেঁটে গেছি , চোখাচুখি হয়ে গেলে আমিই চোখ সরিয়ে নিয়েছি। হয়ত কোন অপরাধবোধে , কি জানি ! কিন্তু প্রতিবারই বাড়ি ফিরেছি একটুকরো মন খারাপ সঙ্গে নিয়ে ।
প্যানডেমিকের বাজারে আর যাওয়া হয়নি ওখানে। লাইব্রেরী কবে খুলবে এখনও জানা নেই। তবে গত সপ্তাহে ওখানে যেতে হয়েছিল। আমাদের মেইল ইন ব্যালটের ড্রপ বক্স ওই সিটি হলের সামনে। ব্যালট জমা করে নিজের গাড়িতে ফিরছি , হঠাৎ মনে হল দূরে সেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে। পার্কিং লটটা প্রায় ফাঁকা। সেই গাড়িটাই না কি আমি ভুল ভাবছি দেখার জন্য একটু এগিয়ে গেলাম। ঠিকই ভেবেছি। সেই গাড়িটাই। দূর থেকে বুঝতে পারিনি ভদ্রমহিলা গাড়ির ভেতর আছেন কিনা। কিন্তু চোখ পড়ল গাড়ির বনেটের দিকে। বনেটের ওপর একটা ফুলদানি আর সেই ফুলদানিতে এক গোছা নানারঙের টিউলিপ । কেউ কি ওনাকে উপহার দিয়েছেন না কি উনি নিজেই সাজিয়ে নিয়েছেন ওনার আশ্রয়ের জায়গাটুকু মন ভাল করার উপকরণে ? আবার তাকিয়ে দেখলাম। টিউলিপগুলো বেশ তাজা, সতেজ। যেন ঝলমল করছে একরাশ ভাল লাগা , ভাল থাকার স্বপ্ন , নতুন আশা।
No comments:
Post a Comment