Sunday, November 1, 2020

টিউলিপ


বেকার বকবক #২৮


বাড়ির কাছেই আমাদের লাইব্রেরী।  সময় পেলেই আমি লাইব্রেরীতে গিয়ে সময় কাটাই।  কাটাতাম বলা উচিত , কারন মার্চ মাস থেকে লাইব্রেরী বন্ধ।  তার আগে অবধি সপ্তাহে অন্তত তিন দিন রোজ কয়েক ঘণ্টার জন্য আমার আস্তানা ছিল  ওই লাইব্রেরী।  চারদিকে বই , বইয়ের গন্ধ আর যে যার মতো পড়াশুনা করা বিভিন্ন বয়েসের মানুষের মধ্যে বসে নিজেও কিছু বই নাড়াচাড়া করে সময় কাটত খুব ভাল।  আমেরিকায় পাবলিক লাইব্রেরী ফ্রি।  অর্থাৎ যে কেউ এসে এখানে বসে পড়াশুনা করতে পারেন , সময় কাটাতে পারেন।  বই ম্যাগাজিন অডিও ভিডিও মিডিয়া ছাড়াও ফ্রি ইন্টারনেট , কম্পিউটার ইত্যাদিও পাওয়া যায় লাইব্রেরীতে। যাদের কম্পিউটার কেনার রেস্ত নেই বা বাড়িতে ইন্টারনেট নেই এরকম মানুষরাও এখানে এসে কাজ সারতে পারেন প্রয়োজন মতো। বিকেল থেকে রাত অবধি তাই অনেক মানুষ আসেন লাইব্রেরীতে।

লাইব্রেরীর উল্টো দিকেই সিটি হল।  দুটো বিল্ডিংয়ের মাঝে অনেকটা সবুজ।  গাছপালা , ঢেউ খেলানো লন।  ছোট একটা লেক।  লেকে হাঁস। মাঝে অনেকটা জায়গা জুড়ে পার্কিং লট।  পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে একটু হেঁটে ঢুকতে হয় লাইব্রেরীতে।  যেহেতু বিকেল সন্ধ্যের দিকে বেশ ভিড় তাই বেশিরভাগ সময় একটু দূরেই পার্ক করতে হত আমায়।  লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দিব্যি লাগত।  একদিন পার্ক করে লাইব্রেরীর দিকে যাওয়ার সময় একটা গাড়ির ওপর চোখ পড়ল।  সাধারণ একটা স্ট্যান্ডার্ড সাইজের গাড়ি।  কিন্তু গাড়ি ভর্তি অনেক জিনিস।  বালিশ কম্বল বিছানা, জামা কাপড় থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেকরকম সামগ্রী দিয়ে গাড়িটা একেবারে বোঝাই ।  এত বোঝাই যে সবকটা জানলায় ঠেসে আছে মালপত্র , কোনরকমে ড্রাইভার সিটে কেউ একজন বসতে পারে।  দেখে একটু অবাক হলাম।  

কিছুদিন পর আরেকদিন লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আবার দেখলাম সেই গাড়িটাই।  একই জায়গায় পার্ক করা।  এবারে ড্রাইভার সিটে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসে আছেন।  আমার সাথে একবার চোখে চোখ হতেই উনি চোখ সরিয়ে নিলেন। তারপর থেকে যখনই আমি লাইব্রেরী যেতাম খুঁজে দেখতাম ওই গাড়িটা আছে কিনা। থাকত। ওই ভদ্রমহিলাও থাকতেন গাড়িতে। কখনও  হয়ত একা  বসে কফি খাচ্ছেন , কখনও আবার গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কিছু জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন। কদিন দেখার পর বুঝে গেছিলাম ওই গাড়িটাই ওনার ঘরবাড়ি , ওই গাড়ির মধ্যেই ঠাসা আছে ওনার স্থাবর অস্থাবর  সব সম্পত্তি। 'হোম' শব্দটার সাথে 'লেস' শব্দের যৎসামান্যতার লেজুড় জুড়ে আমেরিকা এরকম মানুষদের হোমলেস বলে।  

গত মার্চ মাস অবধি প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই দুতিনবার ওনার সামনে দিয়ে হেঁটে  গেছি , চোখাচুখি হয়ে গেলে আমিই চোখ সরিয়ে নিয়েছি।  হয়ত কোন অপরাধবোধে , কি জানি ! কিন্তু প্রতিবারই বাড়ি ফিরেছি একটুকরো মন খারাপ সঙ্গে নিয়ে ।  

প্যানডেমিকের বাজারে আর যাওয়া হয়নি ওখানে।  লাইব্রেরী কবে খুলবে এখনও জানা নেই।  তবে গত সপ্তাহে ওখানে যেতে হয়েছিল।  আমাদের মেইল ইন ব্যালটের ড্রপ বক্স ওই সিটি হলের সামনে।  ব্যালট জমা করে নিজের গাড়িতে ফিরছি , হঠাৎ মনে হল দূরে সেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে।  পার্কিং লটটা প্রায় ফাঁকা। সেই গাড়িটাই না কি আমি ভুল ভাবছি দেখার জন্য একটু এগিয়ে গেলাম। ঠিকই ভেবেছি। সেই গাড়িটাই।  দূর থেকে বুঝতে পারিনি ভদ্রমহিলা গাড়ির ভেতর আছেন কিনা।  কিন্তু চোখ পড়ল গাড়ির বনেটের দিকে। বনেটের ওপর একটা ফুলদানি আর সেই ফুলদানিতে এক গোছা নানারঙের টিউলিপ ।  কেউ কি ওনাকে উপহার দিয়েছেন না কি উনি নিজেই সাজিয়ে নিয়েছেন ওনার আশ্রয়ের জায়গাটুকু মন ভাল করার উপকরণে ? আবার তাকিয়ে দেখলাম।  টিউলিপগুলো  বেশ তাজা, সতেজ।  যেন ঝলমল করছে একরাশ ভাল লাগা , ভাল থাকার স্বপ্ন , নতুন আশা।  

Sunday, January 26, 2020

নাঃ


বেকার বকবক #২৭

প্রেমের ব্যাপারে তপু বরাবরই যাকে বলে ফেলিওর। কে জি  ক্লাসে একবার বোধহয় একটি মেয়ের সাথে ভাব আড়ি গোছের একটা সম্পর্ক হয়েছিল কিন্তু তারপর থেকে শুধুই  ধূধূ মরুভূমি।  কিন্তু তাই নিয়ে তপুর কোন আক্ষেপ ছিল না।  কারন ওর মতে প্রেমে অসফলতাটা  ওর হেরিডিটারি।  সুতরাং ওই নিয়ে কোনদিন মাথা ব্যাথা করে সময় নষ্ট করার প্রশ্নই ওঠে না।  তপুর বন্ধু বান্ধবদের যখন একে একে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তখন তপুর বাবা ওর জ্যেঠুর কাছে গিয়ে বললেন , "দাদা , এবার তো ছেলেটার একটা বিয়ের ব্যবস্থা দেখতে হয় " . শোনা যায় জ্যেঠু একটু চিন্তা করে তারপর একটা কাগজে খস খস করে কিছু লিখে ওর বাবাকে দিয়েছিলেন আর সেই কাগজ নিয়ে তপুর বাবা  বিজ্ঞাপনের অফিস ঘুরে আসার কদিন পর থেকে তপু আর রোববার করে পাড়ার ঠেকে আড্ডা মারতে আসত না। বেশ কয়েকটা বাড়িতে মিষ্টি ও সিঙাড়া সাঁটিয়ে  তপু অবশেষে একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছিল। সে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। তখন এখনকার মতো প্রোগ্রেসিভ চিন্তা ভাবনা ছিল না , তার ফলে গণৎকার , জ্যোতিষী এসবের ব্যাপার ছিল না।  ধূমধাম করে তপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল  মিলির সাথে ।  পরে শোনা গেছে ওই বিজ্ঞাপনে কি একটা গন্ডগোল হাওয়ায় ঘোর ঘটি তপু কাঠ বাঙাল মিলিকে  বিয়ে করেছিল।  ব্যাপরটা না কি নিছক একটা প্রিন্টিং মিসটেক।  মানে বিজ্ঞাপনে "পঃ বঃ পাত্রী চাই" ছাপতে গিয়ে "পুঃ বঃ পাত্রী চাই " ছেপে দিয়েছিল।  পাত্রী সবার পছন্দ হয়ে যাওয়ায় পুঃ বঃ কোন ম্যাটার করে নি তখন ।  কিন্তু পরে , বিয়ে যখন জমে ক্ষীর তখন না কি দাম্পত্য কলহে ওই পুঃ বঃ ম্যাটার করতে শুরু করে।  ওই প্রিন্টিং মিসটেককে ঐতিহাসিক ভুল বলে স্বীকার করতেও শোনা যায় তপুকে।   সে যাই হোক , বছর তিরিশ সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় কাটিয়ে তপু আর মিলি এখন অপুর গর্বিত মা বাবা।  অপু এই বৈশাখে ঊনত্রিশ ছোঁবে।

বলাই বাহুল্য অপুর কোন গার্লফ্রেন্ড নেই।  বংশ দেখতে হবে তো !  অনলাইন এ কিছু একটা হয়ে যাবে এই আশায় জল ঢেলে অপু যখন বলেই ফেলল "আমার দ্বারা ওসব হবে না " তখন তপুকে হাল ধরতেই হল।  তপুর বাবা, জ্যেঠু, মিলি  ও তপু একটা ক্যাবিনেট লেভেল বৈঠক  করার পর এই সিদ্ধান্তে এলেন যে টেকনোলজি এ পরিবারের কোন কাজে আসবে না , অন্তত বিয়ের মতো এরকম একটা গুরুতর বিষয়ে।  সুতরাং কাগজে বিজ্ঞাপন, যা এই পরিবারকে বারবার আশার  আলো দেখিয়েছে সেইটাই একমাত্র পথ।

 "আমরা এখন অচল" এই বলে বিজ্ঞাপনে কি লেখা হবে তা নতুন জেনারেশনের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন জ্যেঠু।  মিলির সাথে আলোচনা করে তপু একটা ড্রাফট বানিয়ে বলল "আমি একবার জগাদা কে দেখিয়ে নেব, চিন্তা কোর না "।  জগাদা তপুর অফিসতুতো দাদা , খুব ডিপেন্ডেবল। তারপর একদিন জগাদা ও তপু বিজ্ঞাপনের অফিসে গিয়ে শুভ কাজটা করেই ফেলল।  জগাদা শেষ মুহূর্তে ছোটখাট কিছু চেঞ্জ করে ড্রাফটটাকে ফাইনাল করে দিলেন , জগাদা করছেন মানে চিন্তার কিছুই  নেই।  সেদিন বিজ্ঞাপনের অফিস থেকে ফেরার পথে বিরিয়ানি, দুরকমের  ভাল মিষ্টি  আর জগাদাকে নিয়ে তপু বাড়ি ফিরে সবাই মিলে একটা ছোটখাট পার্টিই করে ফেলল।  একমাত্র ছেলের শুভকাজের প্রথম মাইলস্টোন  বলে কথা ! হঠাৎ বিজ্ঞাপনের রসিদটা  দেখে তপু জিগ্যেশ করল "জগাদা , হিসেবের থেকে তো কমই লাগল দেখছি , তুমি কি কিছু কাটছাঁট করলে ? " জগাদা এক গাল হেসে বললেন, "আরে ওসব পঃ বঃ/পুঃ বঃ আজকাল আর চলে নাকি , ওগুলো কেটে দিয়েছি " . তপু আর মিলির  মধ্যে চোখাচুখি শেষ হওয়ার আগেই জগাদা সেন্টেন্সটা শেষ করলেন , "কেটে শুধু "নাঃ পাত্রী চাই " লিখে দিয়েছি " . "নাঃ পাত্রী চাই মানে ?" প্রায় সবাই কোশ্চেন মার্ক।  "মানে নাগরিক পাত্রী চাই " , সহাস্যে রহস্য ভাঙলেন জগাদা।  শুনে মিলির মুখে এপ্রিসিয়েশনের হাসি , তপু গর্বিত আর ডায়াবিটিসের রুগী জ্যেঠু একটা বড় মিষ্টি খপাৎ করে মুখে পুরে বললেন , "যাক, বাড়িতে একজন অন্তত নাগরিক থাকবে তাহলে ".

প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে সেই পার্টির পর।  অপুর উইকেন্ডে কোন নতুন এপয়েন্টমেন্ট হয়নি এখনও।  বেচারা আজকাল একটু মনমরা।  ওর মাথায় কারনে অকারনে একটা শব্দ ঘোরাফেরা করে আজকাল , "অকৃতদার ".

কাল মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে তপুর কেন যেন মনে হল , "কি জানি ? সত্যিই একটা  ঐতিহাসিক ভুল হচ্ছে না তো এবার  ? "

Readers Loved These Posts