Tuesday, November 7, 2023

সাইকেলওয়ালা

 


এই তো সেদিন # ১


মাঠ ঠিক বলা যায় না , রাস্তার ধারে এক চিলতে ফাঁকা জমি ।  এবড়ো খেবড়ো , অসমান, নিচু।  বৃষ্টি হলেই জল জমে প্রায় ডোবার আকার নেয়।  সেখানেই বাঁশের বেড়া বেঁধে কিছুটা জায়গা ঘেরা হয়েছে। তার ভেতরে একটা ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে । অনেকে ভিড় করে দেখছে।  স্কুল থেকে ফেরার পথে আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম।  আমরা মানে আমি আর মানস।  দেখছি ছেলেটা শুধু গোল হয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, চকের গুঁড়ো দিয়ে করা একটা বৃত্তের মধ্যে ।

“সাতদিন টানা চালাবে “ , মানস  বলল।  
“সাত দিন ? তুই বললেই হল ? “ , আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না ।  
“চ্যালেঞ্জ ? “, মানস সব ব্যাপারেই আমার থেকে অনেক বেশী জানে, তাই চুপ করে গেলাম ।

একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে ।  বাচ্চা থেকে বুড়ো অনেক লোক।  মাঠের কোণে একটা প্যান্ডেল মতো খাটানোর কাজ চলছে ।  সেখানে পাড়ার কয়েকজন দাদা  বেঞ্চ পেতে বসেছে।  মাইকে “কি গাব আমি কি শুনাব আজি আনন্দধামে “। মানস বলল চল বসি। ঘাসের ওপর আমরা বসে পড়লাম স্কুলের ব্যাগ পাশে রেখে। ছেলেটা চালিয়েই যাচ্ছে।  একটা কালো রঙের প্যান্ট আর নীল  হাফ শার্ট। ঘুরতে ঘুরতে যখন আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে তখন দেখলাম টস টস করে ঘাম ঝরছে ওর কপাল আর গাল দিয়ে।  “জোরে, আরও জোরে” বলে চেঁচাল কারা।  আরও উৎসাহে চালাতে লাগল ছেলেটা যেন।  

“আমসত্ব খাবি ? “ , মানস ওর ব্যাগ থেকে বের করল ।  নিলাম।  কিরকম কালো কালো দেখতে আর টকটক স্বাদ ।  “আমার পিসি গোয়া থেকে নিয়ে এসেছে “, বলল মানস। এবার আমাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার চোখে চোখ পড়তে হাত নাড়াল ছেলেটা আমাদের দিকে।  আমরাও হাত নাড়লাম।  ক্লাবের খোকনদা  হঠাৎ ছুটে গেল ওই ঘেরা জায়গাটার মধ্যে। হাতে একটা জলের বোতল।  মানস বলল দেখ , এবার চালাতে চালাতে জল খাবে।  আমরা উঠে পড়লাম। খোকনদা জলের বোতল হাতে পাশে পাশে ছুটছে আর ছেলেটা সাইকেল চালাতে চালাতে এক হাতে বোতল নিয়ে জল খাচ্ছে।  আমরাও গোল হয়ে বাইরে দিয়ে ছুটলাম দেখার জন্য।  কিছুটা জল খেয়ে বোতলের বাকি জলটা নিজের মাথায় ঢেলে দিল ছেলেটা । ওর মুখ গলা জামা ভিজে গেল, দেখে খুব মজা লাগল আমাদের ।

“দেখলি  , যাই করুক থামবে না কখনও।  সাইকেল চালিয়েই যাবে “  
“তুই কি আগে দেখেছিস ? “ , মানসকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না
“নৈহাটিতে মাসীর বাড়ি গেছিলাম , ওখানে হয়েছিল “
“এই ছেলেটাই  ?”
“না না , অন্য একজন “

আমি আগে এরকম কিছু দেখিনি। কেউ একটা বলল ছেলেটা তারকেশ্বরে থাকে।  ওর নাম রুনু। আমাদের থেকে একটু বড়ই হবে। চোখ সরাচ্ছি না আমরা রুনুর ওপর থেকে।  দেখতে দেখতে আমারই মনে হচ্ছে মাথা ঘুরবে এবার। ও কিন্তু পাক মেরেই যাচ্ছে। মাইকের রবীন্দ্রসংগীত শেষ হয়ে তখন “চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত “। হঠাৎ খেয়াল হল বাড়িতে গিয়ে বকুনি খেতে হবে “স্কুল ছুটির পর আর বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না “-র জন্য ।

বাড়ি যাচ্ছি শুনে মানস বলল “রাত্রে আসবি তো? “
“রাত্রে ? কেন ? “
“ আরে সাড়ে নটার সময় ভাত খাবে , দেখবি না ?”
“সাইকেল চালাতে চালাতে ? “
“না খেয়ে থাকবে না কি ! “

‘তাহলে তো আসতেই হবে’ ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে হাঁটা  দিলাম।  

দেরি করার জন্য একটু বকুনি খেলাম। কিন্তু সেসব সেদিন মাথায় ঢোকেনি।  পড়তে বসতে ইচ্ছেই  করছিল না । তবু বসতে হল।  হোমওয়ার্ক আছে , টেস্ট আছে পরদিন।  কিন্তু যাই করি মন সেই মাঠেই পরে আছে । অন্ধকার হয়ে গেল , রাত হয়ে যাচ্ছে । ও কি এখনও সাইকেল চালাচ্ছে ? ওর পা ব্যাথা করছে না ? আচ্ছা বাথরুম যেতে হলে কি করবে ? ঘুম পেলে কি হবে ?

খুব ইচ্ছে করলেও রাত সাড়ে নটার সময় বাড়ি থেকে বেরোব বলার সাহস হল না বাবা মাকে।  রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল কয়েকবার।  ঘুম ভেঙে প্রত্যেকবারই মনে হল সবাই ঘুমোচ্ছে আর রুনু  একা একা ঘুরে যাচ্ছে সাইকেল নিয়ে ! সত্যি ?

সকালে উঠে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে স্কুল যাওয়ার পথে চলে গেলাম ওই মাঠে।   তখনও রুনু সাইকেল চালাচ্ছে।  সেই কালো প্যান্ট আর নীল জামা।  কাছে গিয়ে একটু মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম , ক্লান্ত মনে হল, কিন্তু মুখে হাসি।  স্কুল গেলাম।

এভাবেই কাটল কয়েকদিন । স্কুলে যাওয়ার পথে আর ফেরার সময় ওই মাঠে দাঁড়িয়ে থাকি। স্কুলের আরও বন্ধুরাও আসতে শুরু করল। বাংলা ক্লাসে হোমওয়ার্কে হাতের লেখা খারাপ হওয়ার জন্য বকুনি খাই একদিন তো ক্লাস টেস্টে সহজ অঙ্কের উত্তর অন্য বন্ধুদের সাথে মেলে না আরেকদিন। মাথার মধ্যে সারাক্ষন শুধু গোল হয়ে ঘুরে যাচ্ছে সাইকেলে রুনুদা ।  ও তখন আমাদের সবার রুনুদা হয়ে গেছে।

রুনুদার “সাতদিনব্যাপী লাগাতার সাইকেল চালনা” আমাদের পাড়ার প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠল. সারাক্ষন ভিড় মাঠে। ফুচকা , ঝালমুড়ি বিক্রি হচ্ছে একদিকে। কোয়ালিটি আইসক্রিমের গাড়ি আরেকদিকে। লক্ষ্য  করলাম রুনুদার  জামায় সেফটিপিন দিয়ে টাকার নোট লাগানো। এক টাকা, দুটাকা, পাঁচ টাকার নোট।  যে যা পারছে দিচ্ছে আর সেই টাকা ক্লাবের ছেলেরা ওর শার্টে সেফটিপিন দিয়ে আটকে দিচ্ছে। “যদি সাত দিন টানা চালাতে পারে ওই টাকাগুলো সব ওর “ , মানস কোত্থেকে খবর নিয়ে এসে বলল.

ছয় দিন কেটে গেছে। রাত্রে খেতে বসে বাবা জিজ্ঞেস করল “যাবি  নাকি দেখতে তোর সাইকেলওয়ালাকে ? আজই তো শেষ রাত”. ততদিনে রুনুদাকে  বাড়িতেও সবাই চেনে। যাব না মানে ? রাত প্রায় দশটা । বেশ ভিড়।  বড় বড় লাইট লাগিয়ে মাঠটা ঝলমল করছে।  রুনুদা একটা সাদা রঙের জামা আর কালো প্যান্ট পরে ।  ক্লাবের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম রুনুদা কখন খাবে। বলল ও আজ খাবে না।  শরীর না কি ভাল নেই।  ফ্লাড লাইটের আলোয় ঝলমলে মাঠটায় অনেক হাসি খুশী মানুষ , উৎসব উৎসব ভাব । আর একদিন চালালেই সাতদিন। রুনুদার  মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম কতবার , ঠিক দেখতে পেলাম না। যতবারই দেখতে যাই চলন্ত সাইকেল আর  ফ্লাডলাইট থেকে পড়া তেরছা আলোর মধ্যে পিছলে গিয়ে কিভাবে যেন অন্ধকারে থেকে যায় ওর মুখটা , স্পষ্ট দেখা যায় না । সাইকেল চালাতে চালাতে কিভাবে ভাত খাবে দেখতে পেলাম না বলে একটা আক্ষেপ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম ।  ফেরার সময় রাস্তায় কে একটা বলছে শুনলাম “ ও তো সাইকেল চালিয়েই খায়” .

পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে ওখানে গিয়ে থমকে গেলাম।  কিরকম যেন ভাঙা হাট।  রুনুদাকে দেখতে পেলাম না ।  মানস আমাকে দেখে এগিয়ে এল ।  ওর মুখ থমথমে।

“কি রে ? “
“এ পারবে না আমি সেকেন্ড দিনই বুঝে গেছিলাম  “
“ কি করে ? কি হয়েছে ?“
“মাথা ঘুরে পরে গেছে কাল রাতে।  অজ্ঞান হয়ে গেছিল, হাসপাতালে নিয়ে গেছে “
“কি হবে ? “

মানস জবাব দিল না. হাঁটতে শুরু করল, আমি ওর পিছু পিছু । স্কুল অবধি পুরো রাস্তা আর কোন কথা বলল না মানস।  আমিও না। শুধু রুনুদার জন্য আমাদের বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যাথা রয়েই গেল, নীরবে।   

No comments:

Post a Comment

Readers Loved These Posts