বেকার বকবক #২১
তোমাকে চিঠি লিখিনি কোনদিন। লেখার প্রয়োজন হয়নি। প্রয়োজন হলেও হয়ত লেখা যেত না । ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ মনে পড়ল তোমার কথা আজ । মাইলের পর মাইল লম্বা একটা ব্রিজ। রাতের অন্ধকারে খুব কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল না , রাস্তাটুকু ছাড়া। দিনের বেলায় কতবার গেছি এই রাস্তায়। কিন্তু আজ রাতে কেন জানিনা তুমি এলে , এই পথে, আমার সাথে। অফিস থেকে বেরিয়ে যখন পার্কিং লট-এ হাঁটছি , তখন ঝুপ ঝুপ করে নামছে অন্ধকার। সার বেঁধে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে , মনমরা। গোল হয়ে উড়তে উড়তে কতগুলো অচেনা পাখি আকাশে শূন্য এঁকে দিয়ে যাচ্ছে লালচে কালো দিনশেষের আলোয়। ওই শূন্যের মধ্যে কি তুমি ছিলে ? তুমি কি ছিলে ওই শূন্যতায় ? চলে যাওয়া আলোর পথে ? তবে কেন আজ তুমি এইভাবে … কি জানি , জানি না। ব্রিজের ওপর থেকে দূরে , অনেকটা দূরে ঝাপসা দেখাচ্ছে ওপারটাকে। ব্রিজ পেরোলেই পৌঁছে যাব যে প্রান্তে। স্পষ্ট কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। শুধু কতগুলো আলোর বিন্দু। ওপারে থমকে থাকা কতগুলো বাড়ি , হয়ত রাস্তার আলো , ব্যস্ত জনবসতি , মিটমিট করে জ্বলছে একটা শহর। আলোর বিন্দু গুলো জলের ওপর এঁকে দিয়ে যাচ্ছে একটা স্কেচ। আর জলে ভাসতে ভাসতে স্কেচটা আমার কাছে আসছে , আরও কাছে। কাঁপা কাঁপা জলছবি তে আমি দেখতে পাচ্ছি তোমায়।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লাইব্রেরীর মাঠ , গঙ্গার ঘাটে ভিড় করে কত লোকজন , সাঁ সাঁ করে চলে যাওয়া তিন নম্বর বাস , জিটি রোড। তিনটে ছেলে গঙ্গার ঘাটে জলে পা ডুবিয়ে বসে তর্ক করছে সুনীল, শক্তি না অন্য্ কেউ । এক ফুচকাওয়ালা কিছুতেই ফাউ দেবে না , তাই নিয়ে রক্তচক্ষু একজন। সাইকেল চালিয়ে দুই বন্ধু পাশাপাশি তুমুল আড্ডা দিতে দিতে ফিরছে বাড়ি। রিক্সার প্যাঁক প্যাঁক , বাইক , সাদা Amabassador. গলির মুখটা থমকে আছে , এগোচ্ছে না কিছুই। রাস্তায় বসে আপেল , আঙুর , কমলালেবু বিক্রি করছে গোবিন্দদা , আর এক ভিখারী জুলজুল চোখে দেখছে। এই সব , এই সব আমার চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে time lapse video র মতো ওই জলে। ওই তো যতীন বাবু হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন , ট্রেন ধরার তাড়া। সবার বাড়িতে রেডিওয় একসাথে সাতটা পঁয়ত্রিশের রবীন্দ্রসঙ্গীত, গাইছেন সুবিনয় রায়। কলতলায় হৈচৈ , আপিসের ভাতের গন্ধ , ব্যস্ত দিন সেজে উঠছে আস্তে আস্তে। মাথা নীচু করে হেঁটে চলে গেল একটা মেয়ে, প্রাইভেট টিউশনে। ভোঁ ভোঁ করে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে গেল galloping train টা যে station ছাড়িয়ে , তার নাম উত্তরপাড়া। মফঃস্বল শহর , আমার শহর। আর এইসবের মধ্যে তুমি। আমি দেখছি তোমায়। কতদিন পর। কতদিন পর তুমি সব পাতা উল্টে উল্টে আমাকে দেখাচ্ছো সব কিছু।
স্কুলের ছুটির পর ভিড় করে কুলের চাটনি , সাথে কারেন্ট। লুকিয়ে খাওয়া নর্দমার জল দিয়ে বানানো অমৃত আইসক্রীম। দোলের মেলায় নাগরদোলার ঘুরপাক , লাল টকটকে ডিম কষা আর পাউরুটি। পাড়ার ম্যাচে পাঁচ গোলে হেরে চোখের জল, বাঙাল ঘটি ঝগড়ার মশগুল IFA Shield এর final . অঙ্কে সাত পেয়ে বাবার কাছে বেধড়ক মার, শীতের ছুটিতে গঙ্গার ধারে চড়ুইভাতির খিচুড়ি। চড়কডাঙার মোড়ে হাঁটুজল ভেঙে বৃষ্টির তেলেভাজা, গরমের ছুটিতে মামারবাড়ির হিমসাগর। প্রথম চোট , প্রথম টান , প্রথম হারিয়ে যাওয়া, প্রথম ঢপ। পাতা উল্টে যাচ্ছে একটার পর একটা আর আমি দেখছি তোমার মুখ। হাসিখুশী, চনমনে, বেপরোয়া, ভীতু, ছলছল চোখ।
গাড়ি ছুটছে , তবুও ব্রিজের রাস্তা যেন কমছে না , বেড়েই চলেছে। পৌঁছে যেতে চাই তোমার কাছে , ওই পারে , কিন্তু আরও কি দূরে সরে যাচ্ছ তুমি ? এ পারে San Francisco . ফিটফাট, মেঘ মাখা একটা শহর। এখানে আমার বাস, জানো ? ঠিক শেষ কবে তোমাকে দেখেছিলাম মনে নেই। সেভাবে মনে করা যায় না বোধহয়। সাঁকোটা দীর্ঘ হয়েছে দিন দিন। সে তো প্রায় তিরিশ বছর , বা আরও বেশী। তবু আমার আর তোমার মাঝে সাঁকোটা আছেই। আজ এতদিন পরে চিঠি লিখতে বসে মনে হচ্ছে বলা হয়নি কিছুই। বলিনি ভালবাসি। বলিনি পায়ে পায়ে যতদূরেই যাই চোখের জলে ভেবেছি তোমাকে। বলিনি তুমি ছিলে বলেই আজ এই আমি। তাই লিখতে বসেছি এই চিঠি। জানা নেই ঠিকানা বিহীন এই চিঠি কোন ডাকবাক্সে ফেললে পোঁছে যাবে তোমার কাছে ঠিকঠাক। কতই বা তার মাশুল। তবু লিখছি। হয়ত অনেক বছর ধরে লেখা হচ্ছে এই চিঠি অল্প অল্প করে। এ চিঠির হাড় মজ্জা মাংস গড়ে উঠেছে একটু একটু করে আমাতেই। যদি পাও এই চিঠি একদিন ভালবাসা জেনো , জেনো যদিও তোমাকে ছেড়ে এসেছি অনেককাল , যদিও আমি আর তোমার কাছে নেই তবু তুমি আছো , আমার কাছে , আমার মধ্যে, থাকবে চিরকাল, তুমি, আমার ছেলেবেলা ।